প্রিয় কৃষ্ণকলি তুমি অসুন্দর নয় অনিন্দ্য সুন্দর!

একেক জনের ভালো লাগা ভালোবাসা একেক রকম। পছন্দ, রুচিবোধ, দৃষ্টিভঙ্গি একেক রকম। সবাই সবকিছুতে বিস্মিত হয় না, হয় না বিমুগ্ধ বিমোহিত। কাউকে ধবধবে শুভ্রতায় ব্যাকুল করে, কাউকে শ্যামের স্নিগ্ধ সুন্দরে আকুল করে। কেউ প্রিয় কৃষ্ণকলিতে পায় অনাবিল সুখ। কেউ সাগর ভালোবাসে, কেউ ভালোবাসে নদী। কেউ ভালোবাসে গোলাপ রজনী, কেউ ভালোবাসে টগর বেলী। কেউ পাহাড়ে মুগ্ধ হয়, কেউ ঝর্ণায় নিজেকে হারিয়ে ফেলে। কেউ সাগর কী নদী, গোলাপ কী রজনী, টগর কী বেলি, পাহাড় কী ঝর্ণা, সবগুলোতেই সমান বিমুগ্ধ! এই মুগ্ধতার কোনো নির্দিষ্ট ক্ষেত্র বা সীমা-পরিসীমা নেই। কেউ আপনাতে মুগ্ধ হতে পারে নাও হতে পারে। এটা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। তাই এটা নিয়ে একদমই ভাববেন না।

সুন্দর অসুন্দরের কথা আসলে প্রকৃতিপক্ষে দেখবেন সেখানে সাদা-কালোকে সৌন্দর্যের মানদণ্ড ধরা হয়নি। কালো একটি রঙ মাত্র। এ রঙ কখনো একজন মানুষের বিশেষত্ব হতে পারে না! একজন পুরুষ বা নারীর সৌন্দর্য বিচারের মাপকাঠি হতে পারে না। সুন্দর মানে গায়ের রং সাদা বা ফর্সা হতে হবে, এই ধারণা মূলত এসেছে আমাদের কলোনিয়াল লিগেসি থেকে। কারণ ভিক্টোরিয়ান সৌন্দর্যের যে সংজ্ঞা তাতে গায়ের রং খুব গুরুত্বপূর্ণ। গায়ের রং সাদা হবে, নাক চোখা হতে হবে, চোখ হরিণীর মত হবে ।সৌন্দর্যের ধারণার ক্ষেত্রে আমরা কখনো কলোনিয়াল লিগেসি থেকে তো বের হয়ে আসার চেষ্টা তো করিইনি, বরং সেটা ক্রমে আরো বিস্তৃত হয়েছে।

কালো মানে অসুন্দর নয়। ফর্সা মানেও সুন্দর নয়। কালো এমন এক বস্তু যা দৃশ্যমান আলোর বিকিরণ শোষণ করে নিজে নিষ্প্রভ হয়ে যায়। পরক্ষণে আবার সেখান থেকে নির্মল স্নিগ্ধ আলোর বিচ্ছুরণ ঘটায়। সে আলোয় আলোকিত হয় দিক-দিগন্ত। তাই কালো নয় কালোকে যে অসুন্দর বলে তার দৃষ্টিভঙ্গিই অসুন্দর। কালো তার স্বমহিমায় উজ্জ্বল উদ্ভাসিত অনিন্দ্য সুন্দর। পৃথিবীর সবকিছুই সুন্দর। এই সুন্দর পৃথিবীর প্রতিটা মানুষই সুন্দর। অসুন্দর শুধু শব্দে। আমাদের বিকৃত মানসিকতা, অসুস্থ চিন্তা ও রুচিবোধে। হ্যাঁ মানুষের সেই সৌন্দর্য দেখতে হলে আপনার ভালোবাসাময় দু’টো চোখ লাগবে, উপলব্ধি করার মতো স্বচ্ছ প্রেমময় ও ভালো একটি মন লাগবে, সুন্দর উপলব্ধি করার মতো উন্নত মানসিকতা ও ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি লাগবে। তবেই আপনি দেখবেন পৃথিবী কি সৌন্দর্যের স্বাক্ষর বহন করছে।

ধরুন শপিং মলের একটা ড্রেস আপনার খুব পছন হয়েছে যে কারণে আপনি কিনতে চাচ্ছেন। এখন আপনার সাথের বন্ধু বা ছোট ভাই বোন কে জিজ্ঞাসা করলে বলবে তার পছন্দ হয়নি। তার মানে একই জিনিস অথচ একজনের পছন্দ হচ্ছে অন্য জনের হচ্ছেনা! সুতরাং সুন্দর অসুন্দরের সুনির্দিষ্ট কোন সংজ্ঞা নেই। এটি সম্পূর্ণ আপেক্ষিক বিষয়। ‘যারদৃষ্টি ভঙ্গি যতো সুন্দর জগত তার কাছে তত সুন্দর’। সবার চোখে সব কিছু সব সময় সুন্দর নাও লাগতে পারে। আবার যদি কেউ কোনো অসুন্দর বস্তু বা বিষয়কে সবসময় দেখতে বা শোনতে থাকে, তবে একসময় সেটার সঙ্গে তার ভালো লাগা ও ভালোবাসা হয়ে যায়। এটা বাস্তব সম্মত কথা। সাইক্লোজিক্যাল লজিক এ কথাই বলে।

আপনার পরিচয়, আপনার সৌন্দর্য ত্বকের রঙে নয় চরিত্রে ও মাধুর্যতায়। স্বভাব-চরিত্র, আচার-আচরণ ও ব্যবহারে যে সুন্দর সেই সুন্দর। ধন-সম্পদের প্রাচুর্য , ক্ষমতার দাপট ও বংশীয় ঐশ্বর্য এগুলো শাসন-শোষণমূলক শব্দ। যার সুন্দর ও সফেদ একটি মন আছে প্রকৃত অর্থে সেই সুন্দর। দেখুন বাংলা একাডেমীর বাংলা অভিধানে সুন্দরের সংজ্ঞা কী? সেখানে বলা হয়েছে সৌন্দর্য মানে রূপ, মনোহর, রূপমাধুরী, শোভা। কই কোথাও তো সাদা বা ফর্সা রঙের কথা বলা হয়নি! তাহলে আপনি কেন গায়ের রঙে সৌন্দর্য মাপতে যাবেন?

একবিংশ শতাব্দীর এই সময়ে আমরা অতিমাত্রায় মিডিয়াবান্ধবে পরিণত হয়েছি। সবকিছুতে মিডিয়ার অনুসরণ করি। মিডিয়া আমাদের যেটা দেখাচ্ছে আমরা সেটাই দেখছি, বিশ্বাস করছি। সেটাতেই অভ্যস্ত হয়ে পড়ছি। সে সুযোগে পাশ্চাত্য অপসংস্কৃতির ভয়াল থাবা ও অসভ্য মিডিয়ার সাংস্কৃতিক আগ্রাসন ও বর্ণবাদী নেতিবাচক অপপ্রচার মানুষের মধ্যে এই ধারণার জন্ম দিয়েছে যে, কালো মানেই অসুন্দর। ফর্সা মানেই সুন্দর। বৃটেনের রাজপুত্র প্রিন্স হ্যারি এমন এক মেয়েকে বিয়ে করছে যে পুরাপুরি শ্বেতাঙ্গ না- মিশ্র রক্ত, বয়সে প্রিন্সের থেকে তিন বছরের বড়, তার আগে একবার বিয়ে হয়ে ডিভোর্সও হইছিলো।

কিন্তু বৃটিশ মিডিয়ার অনেক হাহাকার সত্যেও এসব ব্যাপারগুলো তাদের বিয়েতে কোন বাঁধা হতে পারে নাই কারণ এসব কোনটাই মেয়েটার “দোষ” না, তারা একে অপরকে ভালোবাসে- এটাই বড় কথা! এখানে ভালবাসাটাই মূল বিষয় সাদা-কালো নয়।

নাটকে সিনেমায়, গানে, গল্পে, সাহিত্যে, কবিতায় সবখানেই কালোকে অসুন্দরভাবে উপস্থাপন করা হয়। তিন থেকে সাত দিনে রঙ ফর্সা করার স্নো, ক্রিম, কসমেটিক, সাবানের চটকদার সব বিজ্ঞাপন আমাদেরকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছে যে, আমাদেরকে ফর্সা হতেই হবে। না হয় ভালো বিয়ে হবে না। চাকরি হবে না। আমরাও সেটাকে সরল মনে বিশ্বাস করে রূপচর্চার অসম প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েছি। তবে কী লাভ হয়েছে জানি না। আমি আজ পর্যন্ত কাউকে ফর্সা হতে দেখিনি। বিবিসির ২০১৭ সালের এক জরিপে দেখা গেছে, সারা বিশ্বে রং ফর্সাকারী ক্রিমের প্রায় ৪৮০ কোটি ডলারের বাজার রয়েছে৷ ২০২৭ সাল নাগাদ তা বৃদ্ধি পেয়ে দ্বিগুণ হবে মানে ৮৯০ কোটি ডলার।

এভাবে ধারাবাহিক অপপ্রচারের পরম্পরায় মানুষের চিন্তা-চেতনায়, ধ্যাণ-ধারণায় এটি ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে, কালো মানেই অসুন্দর, কালো মানেই অশুভ, কালো মানেই অমঙ্গল, কালো মানেই অলুক্ষণে। আর এ জায়গাটায় সবচেয়ে বেশি বর্ণবাদের শিকার হয়েছে নারী। একজন নারীকে শুধুমাত্র তার গায়ের রং একটু চাঁপা বলে সেই শৈশব থেকে কৈশোরে, যৌবনে থেকে বার্ধক্যে উপনীত হয়ে যাওয়ার পরও কটূক্তি, ভৎসনা ও মানসিক নির্যাতন তার পিছু ছাড়ে না। এ যেন তার নিত্য সঙ্গী!

মাঝেমধ্যে একটা বিষয় ভেবে খুব হাসি পায় আমার সেটি হলো, কসমেটিক যদি রঙ ফর্সা করায় এতোই কার্যকর হয় তাহলে কোম্পানিগুলো আফ্রিকার দেশগুলোতে যায় না কেন? যদি তারা তাদের দাবীতে সত্যবাদী হয় তাহলে আফ্রিকার ওই কালো মানুষদের একটু ফর্সা করে আসুক না দেখি! এখানে আরো একটি কথা বলতে চাই, অনেককে দেখা যায় কালো মেয়েদের এভাবে শান্তনা দেন, ‘জাতের মেয়ে কালো ভালো, নদীর পানি ঘোলা ভালো’।‘কালো গলার মালা সাদা পায়ের তলা’। ‘কালো হলে কী হবে মাশাআল্লাহ্‌ মেয়েটার অনেক গুণ’। ‘চেহারা কালো হবে কী হবে মেয়েটার মনটা অনেক ভালো’। এছাড়াও কালো মেয়েদের শান্তনার জন্য কতো গান, কবিতা, ছন্দ রচিত হয়েছে। আমার কাছে মনে হয়, এসবে শান্তনার বাণী থাকলেও পক্ষান্তরে একটি কালো মেয়ের মনে এটি বদ্ধমূল বিশ্বাসে পরিণত হয়ে যায় যে, সে অসুন্দর। তার মনের অন্তকুহরে একটি চাঁপা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে আহ্ আমি যদি আরেকটু ফর্সা হতাম! অনেকে আক্ষেপ করে বলে, ‘আল্লাহ্‌ আমাকে কেন এতো কালো করে বানালেন! আমি কী দোষ করেছিলাম’!

সল্পসময়ের জন্য আমি ধরেই নিলাম যে, আপনি গায়ের রঙ নিয়ে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। আপনার কিছু ভালো লাগছে না। লোকেরা বলে, আপনি একজন কালো মানুষ বা বলে আপনি বেশ মোটা কিংবা অতিশয় চিকণ। সবাই আপনাকে অসুন্দর বলে। তিরস্কার করে। গায়ের রঙটা একটু কালো বলে বারবার বিয়ে ভেঙ্গে যায়। অফিসে, ঘরে কিংবা বাইরে সবসময় মানুষের বিভিন্ন কথা শোনতে হয়, আপনি সবখানে লজ্জিত হন। আমি আপনার এই দুঃখটা বুঝি। এটাও বুঝি, যখন এভাবে দিনের পর দিন মানুষের অবজ্ঞার শিকার হন তখন হয়তো আপনার যা আছে তা নিয়ে খুশি থাকাটা খুব কঠিন হয়ে যায়। কিন্তু কথা হলো, আপনি এখন কী করবেন? কীভাবে তাদের মুখ বন্ধ করবেন? আপনি তো চাইলেই সাদা হয়ে যেতে পারবেন না। ইচ্ছে করলেই সঙ্গে সঙ্গেই স্বাস্থ্য কমিয়ে ফেলতে পারবেন না। পারবেন না চিকন থেকে মোটা হয়ে যেতে। তাহলে কী করবেন আপনি? আমরা মোটা, চিকন, কালো কান্তিময় যাই হই না কেন, এর উপর আমাদের কারো কোনো হাত নেই। আমরা আমাদেরকে সৃষ্টি করিনি। যিনি সৃষ্টি করেছেন তিনি যাকে যেভাবে সৃষ্টি করা দরকার সেভাবেই সৃষ্টি করেছেন। আমাদের কাছে যেমন আমাদের প্রিয় সন্তান ও প্রিয় মানুষগুলো অনেক অনেক সুন্দর। সুতরাং অসুন্দরের অস্তিত্বই নাই। তাই এখনই সময় কলোনিয়াল চিন্তাভাবনা থেকে বের হয়ে আসার।

আপনি একবার আয়নার সামনে দাড়িয়েই দেখুন না, আপনার রঙটা কোনভাবেই বাজে নয়, আপনার চেহারাটা কিন্তু অসুন্দর নয়। কারো সুন্দর অসুন্দরের স্বীকৃতি অস্বীকৃতিতেও কিছু যায় আসে না। কুরআনে বলেছেন ‘আমি মানুষকে সবচেয়ে সুন্দরতম গঠনে সৃষ্টি করেছি’। (সূরাতিন, আয়াত: ৪)। আবার দেখেন ভগবত কৃষ্ণ ছিলেন কালো। গায়ের রং ফর্সা হতে হবে – এই মানসিকতার পরিবর্তনের জন্যে বিভিন্ন সমাজে নানা ধরনের আন্দোলন চলছে। ভারতে এরকম এক আন্দোলনের নাম: ‘কালোই সুন্দর।’ পাকিস্তানে এরকম এক আন্দোলনের স্লোগান: “সুন্দর হতে হলে আপনার ত্বকের রং ফর্সা হতে হবে না।”

সুতরাং বিষণ্ণতায় ডুবার কিছু নেই। মানুষ যা বলে বলুক, যা বোঝে বুঝুক, যা মনে করে করুক। মানুষের কথা বাদ দিয়ে নিজের উপর আস্থা রাখুন। আপনিই আপনার সম্পর্কে মন্তব্য করুন। নিজেকে নিয়ে মানুষের মন্তব্যের চেয়ে আপনার নিজের মন্তব্যের গুরুত্বই সবচেয়ে বেশি। আপনি তাই যা আপনি নিজে বিশ্বাস করেন। আপনি কালো, মোটা বা চিকণ হয়েও যদি নিজেকে সুন্দর লাগছে অনুভব করেন তাহলে আপনি সত্যিই সুন্দর। আপনার পছন্দ-অপছন্দ, ভালো লাগা না লাগা, কি ভালবাসেন,কাকে ভালবাসেন আপনার জীবনের সকল ভাবনা,সিদ্ধান্ত সব একান্তই আপনার। আপনার পৃথিবী আপনারই সব কিছু।

Leave a Reply